Friday, June 14, 2013

পেশাজীবী যখন অ্যাকটিভিস্ট || মাসুম খলিলী

Activist Journalism

পেশাজীবী যখন অ্যাকটিভিস্ট - - -  অবলোকন



আধুনিক কালে যেকোনো রাষ্ট্র বা সমাজ নানা ধরনের পেশাজীবীর সমন্বয়ে গঠিত হয়। আদিম সমাজে একই মানুষকে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন ধরনের কাজ করতে হতো। সামাজিক অগ্রগতির সাথে সাথে রাষ্ট্রে শ্রমবিভাজনের সৃষ্টি হয়। যে ব্যক্তি যে কাজে দক্ষ, তিনি সে ধরনের কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন। আধুনিক কালে শিক্ষাদীক্ষা বিশেষত উচ্চতর শিক্ষা যেমন বহু ধরনের ডিসিপ্লিনে বিভক্ত তেমনিভাবে কর্মক্ষেত্রেও এ বিভাজন ব্যাপক। এর মধ্যে কোনো কোনো পেশায় নিযুক্তদের প্রভাব থাকে সমাজে প্রত্যক্ষ। এসব প্রত্যক্ষ প্রভাব বিস্তারকারী পেশাজীবীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন প্রশাসনের আমলা, বিচারক, শিক্ষক, সংবাদকর্মী, পুলিশ, নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্য, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবী প্রভৃতি পেশায় নিয়োজিতরা। রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থার ধরন বা প্রকৃতির ওপর আবার এসব পেশাজীবীর কাজ কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে।
একজন ব্যক্তি পেশাগতভাবে আমলা, চিকিৎসক, বিচারক, সাংবাদিক, আইনজীবী বা সৈনিক যা-ই হোক না কেন তার নিজস্ব রাজনৈতিক, ধর্মীয় বা আদর্শগত বিশ্বাস থাকতে পারে। তারা হয়তো সবাই নির্বাচনকালে ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন। গণতান্ত্রিক সমাজে একজন পেশাজীবীর সামনে এই ব্যক্তিগত বিশ্বাস বা আদর্শের বাইরে পেশাগত বিধিবিধান, রীতিনীতি, ঐতিহ্য ও অনুসরণীয় বিষয়ও থাকে। পেশাগত দায়িত্ব যখন তিনি পালন করবেন তখন তার কাজে পেশার নিজস্ব রীতিনীতি বা অনুসরণীয় বিষয়ের প্রতিফলন কাক্সিত মনে করা হয়। তার ব্যক্তিগত বিশ্বাস বা আদর্শ পেশাগত দায়িত্ব পালনে অযৌক্তিকভাবে যখন প্রাধান্য বিস্তার করে, তখন দেখা দেয় বিপত্তি। এই প্রাধান্য মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে সামাজিক বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়।
একজন চিকিৎসক তিনি ধর্মীয় বিশ্বাসের দিক থেকে মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান যেকোনো কিছু হতে পারেন। রাজনৈতিকভাবে তিনি যেকোনো দল বা আদর্শের সমর্থকও হতে পারেন। কিন্তু অসুস্থ ব্যক্তির চিকিৎসা যখন তিনি করবেন, তখন পীড়িত ব্যক্তি কোন ধর্ম বা কোন রাজনীতির সমর্থক, তা বিবেচ্য হতে পারে না। একইভাবে একজন শিক্ষক যখন শিক্ষাদান করবেন, তিনি জ্ঞানের আলো বিতরণের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ধর্মীয় বা ব্যক্তিগত কারণে ছাত্রদের প্রতি কোনো তারতম্য করবেন না। একজন পুলিশের দায়িত্ব হলো দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের মূলনীতির ভিত্তিতে রাষ্ট্র ও সমাজে আইনের প্রয়োগ ও শৃঙ্খলা বিধান করা। এ জন্য আইন প্রচুর ক্ষমতা বা এখতিয়ার দিয়েছে পুলিশকে। অপরাধ সংগঠনের জন্য তৎপর হতে পারে বলে সন্দেহ হলে যে-কাউকে আটক করতে পারে পুলিশ। অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পর তার জন্য কাউকে দায়ী মনে করলে তাকে গ্রেফতারও করতে পারে পুলিশ। কিন্তু এ ক্ষমতার উদ্দেশ্যমূলক প্রয়োগ হতে পারে মারাত্মক। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনা প্রাধান্য পেলে যিনি অপরাধ ঘটাচ্ছেন তিনি রেহাই পাবেন আর আটকে যাবেন নিরপরাধ মানুষ। বেসামরিক আমলা যারা রাষ্ট্রের প্রশাসনকে নীতিনির্ধারণপর্যায় থেকে মাঠের তৃণমূলপর্যায় পর্যন্ত কার্যকর করার ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ দায়িত্ব পালন করেন তাদেরও ব্যাপক ক্ষমতা রয়েছে। জনপ্রশাসনে এসব আমলার দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট রীতিপদ্ধতি ও অনুসৃতি রয়েছে। আবার ক্ষমতা প্রয়োগে নিজস্ব বিবেচনাবোধের সুযোগও তাদের আছে। সমাজের অত্যন্ত সচেতন অংশ হিসেবে তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের পাশাপাশি রাজনৈতিক সমর্থন থাকাও স্বাভাবিক। কিন্তু এটি কোনোভাবেই প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে নির্ণায়ক হতে পারে না। বাংলাদেশের বিচার ক্ষেত্রে নিম্ন আদালতের বিচারক ও উচ্চতর আদালতের বিচারপতিদের একটি অংশ বিচার ক্যাডারের কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পেয়ে থাকেন। হাইকোর্টে বিচারপতিদের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ নিয়োগ পেয়ে থাকেন আইনজীবীদের মধ্য থেকে। প্রথমোক্তদের রাজনৈতিক বিশ্বাস বা সমর্থন ততটা জোরালো না হলেও আইনজীবীদের রাজনৈতিক সমর্থন থাকে বেশ সক্রিয়। কিন্তু বিচারপতি হিসেবে নিয়োগলাভের পর এ পেশার জন্য যে আচরণবিধি ও রীতিনীতি রয়েছে দায়িত্ব পালনে তা অগ্রাধিকার পাওয়াটি  কাঙ্ক্ষিত । সেটি না হয়ে রাজনৈতিক বা আদর্শগত চেতনা দায়িত্ব পালনে মুখ্য হয়ে পড়লে ন্যায়বিচার করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াতে পারে বিচারকের পক্ষে। গণমাধ্যমকে বলা হয় সমাজের দর্পণ। গণমাধ্যম  সেটি প্রিন্ট বা ইলেকট্রনিক যেটিই হোক না কেন, তাতে সমাজের সচেতন ও সংবেদনশীল মানুষ বেশি যুক্ত হন। তাদের রাজনৈতিক বিশ্বাস ও সচেতনতাও থাকে প্রখর। তবে বিশ্বেও দেশে দেশে সংবাদকর্মীদের জন্য যে কোড অব ইথিকস রয়েছে, তাতে অবিকৃত ও যথার্থ খবর পরিবেশনকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। রাজনৈতিক ভাবাদর্শ যেখানে সংবাদকর্মীর এ নীতিবোধকে আচ্ছন্ন করে ফেলে, সেখানে গণমাধ্যম আর দর্পণের ভূমিকা রাখতে পারে না। সিএনএন বিশ্বের খ্যাতনামা টিভি চ্যানেলগুলোর একটি। এই চ্যানেলের সংবাদকর্মীদের জন্য সংবাদ পরিবেশনে নীতিবোধের ওপর এক বিশেষ নিবন্ধ লেখেন সাংবাদিকতার খ্যাতনামা অধ্যাপক ও যুক্তরাষ্ট্রের দেপাউ ইউনিভার্সিটির জ্যানেট প্রিন্ডন ইনস্টিটিউটের পরিচালক বব স্টিল। এ লেখায় বব একটিভিজম বা সক্রিয়তাবাদ প্রধান সাংবাদিকতার বিপদ সম্পর্কে কথা বলেন। তিনি লেখেন, ‘নৈতিক নীতিমালা এবং দক্ষতা অঙ্গীকার ও সাহসের ভিত্তির মাধ্যমে নির্দেশিত হবে সাংবাদিকতা  এটিই আমি বিশ্বাস করি। তবে আদর্শগত পক্ষপাত ও সক্রিয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি আক্রান্ত সংবাদ নির্মাণের ব্যাপারে আমার তীব্র উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা রয়েছে। বাম, ডান বা অন্য কোনো ধরনের আদর্শ যার মাধ্যমে সক্রিয়তাবাদের পক্ষে যুক্তি দেয়া হোক না কেন, আমি এসব ব্যাপারে উদ্বিগ্ন। গণমাধ্যমের স্বাধীনতার যে মৌলিক নীতিমালা রয়েছে, তা গুরুত্বপূর্ণ ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার জন্যই কাজে লাগাতে হবে।’
সিএনএনের সংবাদ পরিবেশনের বস্তুনিষ্ঠতা নিয়েই যেখানে বব স্টিলের উদ্বেগের অন্ত নেই, সেখানে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক মাসগুলোর প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমের অবস্থা দেখলে তার উদ্বেগ কোথায় গিয়ে পৌঁছত, তা ভাবনার ব্যাপার।
অ্যাকটিভিজম বা সক্রিয়তাবাদের পেছনে কোনো যুক্তি যে নেই তা নয়। যারা পেশাগত দায়িত্ব পালনের মধ্যেই রাজনৈতিক বা আদর্শগত লক্ষ্য অর্জন করতে চান, তাদের বক্তব্য হলো  সক্রিয়তাবাদ হলো এমন নীতি বা কাজ, যা ব্যাপক প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে রাজনৈতিক বা সামাজিক পরিবর্তন আনার জন্য করা হয়। অ্যাকটিভিস্ট বা সক্রিয়তাবাদী হলেন সেই ব্যক্তি যিনি রাজনৈতিক ও সামাজিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য তার অবস্থানকে কাজে লাগান। বাংলাদেশের গণমাধ্যমে এ ধরনের অ্যাকটিভিস্ট সাংবাদিক অনেক রয়েছেন। এর বাইরে সাংবাদিকদের মধ্যে রাজনৈতিক কর্মী বা আদর্শের সমর্থকও রয়েছেন কিন্তু তারা মন্তব্য প্রতিবেদন ছাড়া অন্য কোনো সংবাদ প্রতিবেদনে তাদের নিজস্ব মতামতের প্রতিফলন ঘটান না। অ্যাকটিভিস্ট সাংবাদিকেরা সংবাদকর্মীদের জন্য বিশ্বস্বীকৃত কোড অব ইথিকসের তথ্য অবশ্যই যথার্থ ও বস্তুনিষ্ঠ হতে হবেÑ এ নীতির ব্যত্যয় ঘটান রাজনৈতিক আদর্শের প্রশ্ন এলে। এ আদর্শ উজ্জীবিত বা রাজনৈতিকান্ধ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে কোনো সময় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, কোনো সময় সেকুলারিজম আবার কোনো সময় মৌলবাদ-বিরোধিতার কথা বলা হয়। কিন্তু অ্যাকটিভিস্ট জার্নালিজমের জন্য পাঠকেরা যথার্থ তথ্য থেকে বঞ্চিত হন। শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চ প্রতিষ্ঠার পর বাংলাদেশের বেশির ভাগ সংবাদপত্র ও টেলিভিশন এটিকে এমনভাবে কাভারেজ দেয়, যাতে মনে হয় এ ঘটনার বাইরে কয়েক সপ্তাহ ধরে বাংলাদেশে সংবাদ হওয়া বা প্রথম পৃষ্ঠায় গুরুত্ব পাওয়ার মতো কোনো ঘটনা ছিল না। পরে হেফাজতে ইসলামের সভা-সমাবেশ ও আন্দোলনের সময়ও একই চিত্র দেখা গেছে। অবশ্য গণমাধ্যমে এর প্রতিফলন ঘটেছে উল্টোভাবেÑ তথ্য গোপন করে অথবা বিকৃত করে। এর ফলে সার্বিকভাবে সংবাদপত্রের পাঠক কমে গেছে আর দর্শকশ্রোতা কমেছে ইলেকট্রনিক মাধ্যমের।
বাংলাদেশে জুডিশিয়াল অ্যাকটিভিজম বা বিচার বিভাগের সক্রিয়তাবাদও সাম্প্রতিক সময়ের বেশ আলোচিত বিষয়। জুডিশিয়াল অ্যাকটিভিজম বলতে বর্ণনা করা হয় বিদ্যমান আইনের পরিবর্তে ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক বিবেচনাকে সামনে রেখে বিচার বিভাগীয় রুলিং বা সিদ্ধান্ত দেয়াকে। এটি অনেক সময়ে বিচার বিভাগকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে ব্যবহার করা হয়। জুডিশিয়াল অ্যাকটিভিজমের সংজ্ঞা এবং সুনির্দিষ্টভাবে কোন সিদ্ধান্তটি সক্রিয়তাবাদী, তা একটি বিতর্কিত রাজনৈতিক ইস্যু। বাংলাদেশের জুডিশিয়াল অ্যাকটিভিজমের স্থপতি মনে করা হয় সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হককে। তিনি হাইকোর্ট বিভাগ ও আপিল বিভাগে বিচারক থাকাকালে এবং প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় অনেক রায় দিয়েছেন, যেগুলোকে আদালত অঙ্গনে জুডিশিয়াল অ্যাকটিভিজমের নমুনা হিসেবে তুলে ধরা হয়। সংবিধানের পঞ্চম ও ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায়কে এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য মনে করা হয়। বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের অনুসরণে বেশ কয়েকজন বিচারপতি গুরুত্বপূর্ণ রায় দেয়ার ক্ষেত্রে এ নীতি অনুসরণ করেন। এর মধ্যে একজন বিচারপতি এ ব্যাপারে প্রকাশ্য যুক্তিও তুলে ধরেন এবং এ ক্ষেত্রে বিচারপতি খায়রুল হকের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে বলেন, দেশের জন্য বড় কিছু অর্জন করতে হলে জুডিশিয়াল অ্যাকটিভিজমের বিকল্প নেই। বাংলাদেশের শাসনতন্ত্র বর্তমানে যে রূপ নিয়েছে, তা বিচার বিভাগীয় সক্রিয়তাবাদের ফসল হিসেবেও তিনি বর্ণনা করেন।
জুডিশিয়াল অ্যাকটিভিজমের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির আইনশাস্ত্রের অধ্যাপক রবার্ট পি জর্জ একটি বই লিখেছেন। জুডিশিয়াল অ্যাকটিভিজম অ্যান্ড দি থ্রেট অব দি কনস্টিটিউশন নামে এই বইয়ে রাষ্ট্রব্যবস্থা ও গণতন্ত্রের জন্য বিচারিক সক্রিয়তাবাদ কী ধরনের বিপদ নিয়ে আসে, তার ওপর বিস্তারিত আলোকপাত করেছেন রবার্ট। তিনি বলেছেন, ‘বিচারিক ক্ষমতা ভালো ও মন্দ দুইভাবে ব্যবহার করা যায় এবং করা হয়। আইনের যথাযথ বিধানকে এড়িয়ে কোনো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিচারিক ক্ষমতা প্রয়োগ কাক্সিক্ষত নয়। বিচারপতিরা কোনোভাবেই আইনপ্রণেতা নন। যেসব ক্ষেত্রে আইনপ্রণেতাদের সিদ্ধান্তকে বাতিল করা হয়, সেসব ক্ষেত্রে বিচারকদের সিদ্ধান্ত আইনসঙ্গত কি না তার ওপর এটি বিশেষভাবে নির্ভর করে। বিচারকেরা এ ক্ষেত্রটি নিয়ে সিদ্ধান্ত প্রদান করার আইনি এখতিয়ার যে রাখেন, তার যথার্থতা এ ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। যেখানে আইনি এখতিয়ারের দাবি অসত্য ভিত্তিতে দাঁড়ানো থাকে, সেখানে কোনো বিচারিক ডিক্রির ক্ষতি সদিচ্ছা দিয়ে পুনরুদ্ধার করা যায় না। আদালত যদি কোনো সিদ্ধান্ত বা রায়ের মাধ্যমে জনগণের কর্তৃত্ব অবৈধভাবে দখল করে বসে তা শুধু ভুল পদক্ষেপই হয় না, এর মাধ্যমে সিদ্ধান্তদানকারী বিচারকেরা নিজেদের অসাংবিধানিকও করে তোলেন। আর সেই সাথে তারা নিজেদের দাঁড় করান অন্যায়ের পক্ষের কাতারে।’
বাংলাদেশের সংবিধানে শাসনতন্ত্র সংশোধনের যে ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, তাতে এটি করতে পারে আইনসভা। সংবিধানের সংযোজন, বিয়োজন ও পরিমার্জনের এখতিয়ার সংসদের। জুডিশিয়াল রিভিউর আওতায় সংবিধানের ব্যাখ্যা দানের এখতিয়ার রয়েছে উচ্চতর আদালত তথা সুপ্রিম কোর্টের। এই জুডিশিয়াল রিভিউর মাধ্যমে যে কেস ল স্থাপিত হয়, তা প্রয়োগ করা হয় সংবিধান পরিবর্তনেও। এ রকম একটি উদ্যোগ ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট সীমিত ক্ষেত্রে একবার নিয়েছিল; কিন্তু ভারতীয় সংসদ সেটিকে এখনো গ্রহণ করেনি। পাকিস্তানের বর্তমান প্রধান বিচারপতি ইফতেখার চৌধুরীর বেশ কিছু সিদ্ধান্তকেও জুডিশিয়াল অ্যাকটিভিজম হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। যদিও তিনি গুরুত্বপূর্ণ কিছু আইন বাতিলের রায় দিলেও শাসনতন্ত্রের কোনো অংশ বাতিল করা পর্যন্ত অগ্রসর হননি।
জুডিশিয়াল অ্যাকটিভিজমের সমালোচকেরা মনে করেন রাজনীতি ও আদর্শ-আক্রান্ত বিচার আইনের শাসন ও গণতন্ত্রকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়। আইনের চোখে সব নাগরিক সমান অ্যাকটিভিজমে বিশ্বাসী বিচারপতিদের রায়ে তার প্রতিফলন সব সময় ঘটে না। আইন বা সংবিধানের ব্যাখ্যা দেয়ার সময় তাদের ব্যক্তিগত মতামত বা আদর্শ রায়কে প্রভাবিত করে। জুডিশিয়াল অ্যাকটিভিজমের নানান ধরন দেখা যায়। একনায়কতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শাসকেরা নিজেদের স্বার্থে জুডিশিয়াল অ্যাকটিভিজমকে কাজে লাগায়। আবার কোনো কোনো দেশে রাজনৈতিক ব্যবস্থার নেপথ্য নিয়ন্ত্রকেরা সরকার ও রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণে জুডিশিয়াল অ্যাকটিভিজমের আশ্রয় নেন। তুরস্ক ও থাইল্যান্ডে একসময় এর যথেচ্ছ ব্যবহার করা হয়েছে। বিচার বিভাগের সিদ্ধান্তে একের পর এক সরকারের পতন ঘটেছে। মিসরে এখন জুডিশিয়াল অ্যাকটিভিজমের জোরদার চর্চা শুরু হয়েছে। সর্বজনস্বীকৃত অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদের নিম্নকক্ষ ও উচ্চকক্ষ দু’টিই বাতিল করে দিয়েছেন সাংবিধানিক আদালত।
রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গে যে ভারসাম্য রয়েছে, তা ভঙ্গুর রূপ নেয় যেকোনো একটি অঙ্গ অ্যাকটিভিজমে আক্রান্ত হলে। নির্বাচিত হওয়ার পরও সরকার আগ্রাসী হয়ে পড়ে সক্রিয়তাবাদে আক্রান্ত হয়ে। শাসন বিভাগ সক্রিয়তাবাদে আক্রান্ত হলে আইনের বিধানের বিকৃত সুযোগ নেয় সরকার। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরদ্ধে লাখ লাখ মামলা দায়ের, রাজনৈতিক নেতাদের ডাণ্ডাবেড়ি পরানো, রিমান্ডে নিয়ে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো, রাজনৈতিক কর্মসূচিতে দেখামাত্র গুলি করার নির্দেশÑ এসবকে এক্সিকিউটিভ অ্যাকটিভিজম হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। অ্যাকটিভিজমে আক্রান্ত হলে নির্বাচিত সরকারও গণতান্ত্রিক ও সহিষ্ণু আচরণ করে না। আচার-আচরণে হয়ে পড়ে সর্বাত্মকবাদী।
আইনসভাও কোনো কোনো সময় অ্যাকটিভিজমে আক্রান্ত হয়। এটি বেশি দেখা যায় যখন সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা কোনো দলের হাতে যায়। তখন তারা ইচ্ছামতো শাসনতন্ত্র সংশোধন করতে পারে। এ ধরনের অ্যাকটিভিজম একসময় বাংলাদেশকে একদলীয় শাসনব্যবস্থা উপহার দিয়েছিল। গণমাধ্যম হারিয়েছিল স্বাধীনতা। এ ক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারানোর ভয় থাকে না বলে যেকোনো ধরনের আইনের পরিবর্তন-পরিমার্জনে যুক্তির সীমারেখা সব সময় মান্য করা হয় না। আইন পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠরাই সরকার গঠন করে বলে এ দু’টি বিভাগ অনেকটাই একই সমান্তরালে চলে। অবশ্য সংসদে বিরোধী দল সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা আইন প্রণয়ন করতে না পারলেও সমালোচনা করতে পারে। রাষ্ট্রের এ দু’টি অঙ্গের এখতিয়ারবহির্ভূত কার্যক্রম চেক দেয়ার জন্য গণতান্ত্রিক-ব্যবস্থায় বিচার বিভাগ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু আইন ও শাসন বিভাগের একই সমান্তরালে যদি বিচার বিভাগও কোনো দেশে অ্যাকটিভিজমে আক্রান্ত হয়, তখন পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থাই জটিল চক্রে ঘুরপাক খেতে থাকে।
কোনো ব্যক্তি সাম্প্রদায়িক বা ধর্মান্ধ হলে ভিন্ন ধর্মের প্রতি সহনশীলতার বোধ হারিয়ে ফেলে। তখন সাম্প্রদায়িক হানাহানি ও সহিংসতার সৃষ্টি হয়। আর কোনো অসহিষ্ণু রাজনীতি-অন্ধের হাতে ক্ষমতা গেলে রাষ্ট্র রূপ নেয় নিপীড়কের ভূমিকায়। তখন দেশের নাগরিকেরা হয়ে পড়েন অসহায়। এ অবস্থা সত্যিকার অর্থেই দেশের মানুষের জন্য নজিরবিহীন দুর্ভাগ্য ডেকে আনে। এমন দেশের সংখ্যা পৃথিবীতে এখন যেন দিন দিন বেড়েই চলেছে।
mrkmmb@gmail.com            Source

No comments:

Post a Comment