Saturday, July 6, 2013

মিসর সংকটের ৫ নায়ক

যুগান্তর ডেস্ক
প্রকাশ : ০৫ জুলাই, ২০১৩
মিসর সংকট আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।


মিসর সংকট আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। সেনাবাহিনীর হাতে ক্ষমতার লাগাম চলে গেছে। পরিত্যক্ত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসি যদিও নিজেকে বৈধ বলে দাবি করে চলেছেন। কিন্তু মুরসি পতনের খবরে আনন্দের ফোয়ারা দেখা গেছে বিরোধী দলগুলোর মধ্যে। মুরসিকে এখন অনেকেই সাবেক, ব্যর্থ ও ‘কুলাঙ্গার’ প্রেসিডেন্ট হিসেবে অভিহিত করছেন। ক্ষমতায় আরোহণের মাত্র এক বছর পার হতে না হতেই মুরসির বিদায় ঘণ্টা বাজিয়ে দিল দেশটির শক্তিশালী সেনাবাহিনী। রাজপথের আন্দোলনকে স্বাগত জানিয়ে দেশের মানুষের ভাগ্যবিধাতার আসনে বসেছে সেনাকর্মকর্তারা। তারা মানুষের অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার পক্ষে অবস্থান নিয়ে ক্ষমতার মসনদ দখল করেছে। আর সংশয় এখানে আরও ঘনীভূত হয়, যেখানে সেনাবাহিনী গণতন্ত্রকে বৃদ্ধাঙুলি দেখিয়ে রাষ্ট্রের শাসন ভার নিজেদের কাঁধে তুলে নেয়। কিন্তু মুরসিকে হটিয়ে মিসরের শাসনভার সেনাবাহিনীর হাতে যাওয়ার পেছনে যার নেপথ্যের খেলোয়াড় হিসেবে ঘুঁটি চালাচালি করেছেন এবং এখনও করছেন তারাই মূলত সংকটের নায়ক। অবশ্য কারও কারও ভূমিকা এখন খলনায়কের কাতারে ফেলে বিবেচনা করা হচ্ছে। এরকম ৫ জন শীর্ষ মিসরীয় যাদের হাত ধরে মিসর নতুন করে সংকটের সাগরে ডুবতে বসেছে তাদের দিকেই এখন বিশ্ববাসীর নজর। তাদের বর্তমান কাজ ও ভূমিকার ওপর নির্ভর করছে সংকটের মিসরের ভালো-মন্দ। এক নজরে দেখে নেয়া যাক সেই নায়ক-খলনায়কদের।
মোহাম্মদ মুরসি
২০১১ সালে ৩০ বছরের স্বৈরশাসক হোসনি মোবারকে পতনের পর মোহাম্মদ মুরসি মিসরের প্রথম গণতান্ত্রিক প্রেসিডেন্ট হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। আরব বসন্ত নামক গণ-বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতীকে পরিণত হন মুরসি। কিন্তু কট্টর ইসলামপন্থী ব্রাদারহুডের প্রার্থী হওয়ায় মুরসির গায়ে লেগে যায় ‘পক্ষপাতি’ প্রেসিডেন্টের দাগ। প্রেসিডেনশিয়াল নির্বাচনে প্রায় ৫১ শতাংশ ভোট পেয়ে ২০১২ সালে ক্ষমতায় আসেন মুরসি। কিন্তু তার দলীয় সমর্থকরা রাজনৈতিক ক্ষমতার সীমাহীন অপব্যবহার করে বলে প্রথম থেকেই অভিযোগ করে আসছিল অপেক্ষাকৃত উদার রাজনৈতিক দলগুলো। সেদিকে খেয়াল না দেয়ার খেসারত হিসেবে অবশেষে উৎখাত হতে হল তাকে। বুধবার বাংলাদশে সময় রাত ১০ সময় মুরসির সরকারকে অকার্যকর ঘোষণা করে ক্ষমতা গ্রহণ করছে সেনাবাহিনী। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর গণদাবির প্রতি লক্ষ্য না করে দলীয় চেতনাকে রাষ্ট্রে প্রোথিত করার যে কৌশল নিয়েছিলেন মুরসি তারই মাশুল দিতে হচ্ছে তাকে। মুরসিকে হয়তো এবার জনতার কাঠগড়ায়ও দাঁড়াতে হতে পারে মুরসিকে।
জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি
মিসরের শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তার আসনে অধিষ্ঠিত জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি। তিনি দেশটির সামরিক বিভাগেরও প্রধান। মুরসির মনোনীত হিসেবে তিনি ২০১২ সাল থেকে দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে আসছেন এবং ইসলামী গোষ্ঠী মুসলিম ব্রাদারহুডের ঘনিষ্ট হিসেবে সুপরিচিত। কিন্তু সব হিসাব গড় বড় করে সেনানায়ক সিসি মুরসিকে ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দেন। বিরোধীদের দাবি নিয়ে সমঝোতায় পৌঁছার যে হুশিয়ারি দেন সিসি তাতে গতি আনতে না পারায় বুধবার এক টেলিভিশন ভাষণ নিয়ে জাতির সামনে হাজির হন তিনি। সিসি স্পষ্ট ঘোষণা দেন, মোহাম্মদ মুরসি আর প্রেসিডেন্ট নন এবং দেশের সংবিধান স্থগিত করা হল। জেনারেল সিসি যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বলে প্রচার আছে এবং প্রতিবছর যুক্তরাষ্ট্র মিসর সেনাবাহিনীর উন্নয়নে ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সাহায্য দিয়ে থাকে। এদিকে মোহাম্মদ মুরসির অপসারণের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শীর্ষ সাংবিধানিক আদালতের প্রধান বিচারপতি আদলি মনসুরের নাম ঘোষণা করেছে সেনাবাহিনী। মোহাম্মদ মুরসি এ পদে নিয়োগ দিয়েছিলেন মনসুরকে। এর আগে তিনি এ আদালতের প্রথম উপ-প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালন করতেন।
মোহাম্মদ আল বারাদি
মোহাম্মদ আল বারাদি জাতিসংঘের সাবেক কূটনীতিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মুরসি পতনের উত্তাল আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা ‘তামারুদ’ গ্র“পের সংগঠক হিসেবে কাজ করেন তিনি। প্রেসিডেন্ট মুরসি, মুসলিম ব্রাদারহুড ও তাদের তৈরি সংবিধানের চাচাছোলা সমালোচক হিসেবে তিনি পরিচিত। মুরসি হটাও আন্দোলনে তিনি সামরিক বাহিনী এবং ন্যাশনাল স্যালভেশন ফ্রন্ট কোয়ালিশন ও মুরসিবিরোধী তরুণ প্রজন্মের মধ্যে সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করছেন। মুরসিকে দেয়া ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম শেষ হওয়ার কিছু আগে তিনি জেনারেল সিসির সঙ্গে একান্ত বৈঠক করেন। বুধবার জেনারেল সিসির দেয়া টেলিভিশন ভাষণের সময় তিনি তার সঙ্গে ছিলেন এবং মুরসির পতনের ব্যাপারে একটি সংক্ষিপ্ত বক্তব্যও দেন।
খাইরাত আল-সাতের
২০১১ সালে হোসনি মোবারক দেশে জরুরি অবস্থা জারির পর থেকে খাইরাত আল সাতেরকে আরব বসন্ত বিপ্লবের অগ্রভাগে থেকে নেতৃত্ব দিতে দেখা গেছে। তিনি মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রভাবশালী নেতা। তিনি ব্রাদারহুডকে একক রাজনৈতিক দলের পতাকাতলে নিয়ে এসে মুরসিকে তার একক প্রেসিডেন্ট প্রার্থী করায় প্রধান সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করেন। তিনি নিজেও প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন কিন্তু জেলখাটা আসামি হওয়ায় তা সম্ভব হয়নি। তিনি ব্রাদারহুড ও সামরিক বাহিনীর মধ্যে যোগাযোগ রক্ষায় কাজ করে থাকেন।
পোপ তাওয়াডরোস দুই
পোপ তাওয়াডরোস দুই মিসরের কপটিক অর্থোডক্স চার্চের ১১৮তম প্রধান পোপ। এপ্রিলে চার্চে আক্রমণে ৬ খ্রিস্টান নিহত হলে পোপ তাওয়াডরোস এর তীব্র সমালোচনা শুরু করেন। মিসরের খ্রিস্টানদের নিরাপত্তা দিতে মুরসি সরকার ব্যর্থ বলে অভিযোগের তীর ছোঁড়েন তিনি। মিসরের মোট জনসংখ্যার ১০ ভাগ খ্রিস্টান। মুরসিবিরোধী আন্দোলনকে দু’হাত তুলে স্বাগত জানিয়ে তিনি বলেন, মিসরের চুরি হওয়া বিপ্লব আবার ফিরে এসেছে। বুধবার জেনারেল সিসি ও আল বারাদির সঙ্গে টেলিভিশন ভাষণে উপস্থিত থেকে পোপ তাওয়াডরোসও এক সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে অংশ নেন।
শেখ আহমেদ আল তায়েব
শেখ আহমেদ আল তায়েব আল-আজহারের প্রধান ইমাম। তিনি সুন্নি ইসলামের প্রধান ধর্মচিন্তক হিসেবে মিসরে সমাদৃত হন। তিনি হোসনি মোবারকের হাত ধরে ২০১০ সালে এ পদে আসীন হন। আল তায়েব সংস্কারপন্থী ধর্মগুরু এবং ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টির সমর্থক। মুরসির বিরুদ্ধে আলটিমেটাম জাজির পর তিনি বিরোধী নেতা আল বারাদি এবং সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
আমর মুসা
আমর মুসা ছিলেন হোসনি মোবারকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি ২০১২ সালের নির্বাচনে ন্যাশনাল স্যালভেশন পার্টি থেকে লড়েছিলেন। সর্বশেষ সেনাবাহিনী যখন মুরসিবিরোধী পদক্ষেপে হাত লাগিয়েছে তিনি স্বভাবতই তাদের সমর্থন করছেন। তিনি বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তার দল মিসরকে নিয়ে নোংরা রাজনীতির খেলায় মাতেনি এবং তারা ধ্বংসের হাত থেকে মিসরকে যে কোনো মূল্যে বাঁচাতে চান।

No comments:

Post a Comment