Sunday, June 2, 2013

স্বল্প থেকে মধ্য আয় কতদূর পথ / মহসীন হাবিব


সাবেক সচিব মোঃ আসাফউদ্দৌলা প্রায়ই দেশের অগ্রগতি প্রশ্নে হতাশা ব্যক্ত করে থাকেন। তাঁর ধারণা, দেশ অন্ধকারে ডুবে আছে এবং এ অন্ধকার থেকে বের হওয়ার কোনো পথ তিনি দেখতে পাচ্ছেন না।
আশাবাদী মানুষরা হয়তো তার এ মন্তব্যে স্বস্তি বোধ করেন না, কিন্তু বাস্তবতা হলো তাঁর সুস্পষ্ট উচ্চারণের অনেক সত্যতা রয়েছে। সম্প্রতি একাধিক 'টক শো' আলোচনায় আসাফউদ্দৌলা এমন কিছু মৌলিক সমস্যার কথা তুলে ধরেছেন, যা সত্যিই দেশকে স্বল্প আয় থেকে মধ্য আয়ে উন্নীত করার পথে শক্ত অন্তরায় বলে মনে হয়। মাসখানেক আগে তিনি আলোচনায় বলেছিলেন, কীভাবে আপনি উন্নতি করবেন? সম্পদের একটি সীমাবদ্ধতা আছে। আপনি সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার করেও একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারেন। কিন্তু দেশে এমনভাবে জনসংখ্যার বিস্ফোরণ ঘটেছে যে, কোনো পরিকল্পনার মাধ্যমেই এই ছোট্ট ভূমির কোটি কোটি মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। ১৮ ফেব্রুয়ারি দিনগত রাতেও তিনি মানবজমিন সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে আলোচনাকালে একইভাবে দেশের উন্নয়নের জন্য সামনের দিনগুলোতে অন্ধকার দেখছেন, 'কোনো আলো দেখতে পাচ্ছি না' বলে উল্লেখ করেছেন। তার বক্তব্যে এটাই ফুটে উঠেছে, একদিকে যেমন রয়েছে অর্থনীতিতে নানা ধরনের দুর্বলতা, অন্যদিকে রয়েছে সামাজিক ও রাজনৈতিক বোধের অভাব।


অভিজ্ঞ সাবেক সচিব, বর্ষীয়ান কণ্ঠশিল্পীর (তাঁর সবচেয়ে বড় পরিচয় হলো তিনি বাংলা গজলের অদ্বিতীয় শিল্পী। আসাফউদ্দৌলা এবং তাঁর উপমহাদেশখ্যাত নজরুলসংগীত শিল্পী বোন ফিরোজা বেগমের দ্বৈত কণ্ঠে গাওয়া একটি গানকে বাংলা গানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গান বললে মোটেই বেশি বলা হবে না। গানটি হলো_আমাদের গাঁ ছেড়ে তারা আজ গ্যাছে কতদূর...উঠোনে দুই পা মেলে স্মৃতিরা পোহায় রোদ্দুর।)
 
পর্যবেক্ষণ শুনে কিছু মৌলিক প্রতিবন্ধকতার কথা আলোচনার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হলো। একটি দেশে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ছাড়া আলো আসতে পারে না। আর সে অর্থনৈতিক অগ্রগতির অনেকগুলো পূর্বশর্তই বাংলাদেশে হয় এখনো চিহ্নিত হয়নি অথবা বছরের পর বছর অবজ্ঞা করা হচ্ছে।

অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতার এখন যে বৈশিষ্ট্য সে অনুযায়ী একটি দেশকে এগোতে হলে সমান্তরালভাবে সবগুলো সম্ভাবনাকে এগিয়ে নিতে হয়। তা না হলে কোনোক্রমেই একটি বা দুটি সম্ভাবনাময় শিল্প দিয়ে অন্যান্য দেশগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা যায় না। আমাদের গভীরভাবে বুঝতে হবে, অর্থনৈতিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে পণ্য উৎপাদন থেকে শুরু করে এমনকি মুখের ভাষা পর্যন্ত উন্নত করা অপরিহার্য। কিন্তু দুঃখের বিষয় উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য অনেক ক্ষেত্র বাংলাদেশে সঠিকভাবে অ্যাড্রেস করা হচ্ছে না বা যাচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে স্বল্প আয়ের দেশ থেকে মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত করার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন এবং সে লক্ষে এগিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। অর্থনীতিবিদরাও মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার সম্ভাবনার কথা বলেছেন। কিন্তু নিষ্ঠুর বাস্তবতা হলো, উৎস থাকা সত্ত্বেও মিয়ানমার থেকে লবণ কিনে খেতে হয়, দেশের উর্বর ভূমি থাকা সত্ত্বেও পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে আলু-পেঁয়াজ আমদানির ওপর নির্ভর করতে হয়_এভাবে এই অর্থনৈতিক মন্দার যুগে দেশ এগোবে কী করে?
১৯৬৮ সালে জাপান সাবেক পশ্চিম জার্মানির জিডিপি অতিক্রম করে অর্থনৈতিকভাবে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ শক্তি হিসেবে দেখা দিয়েছিল। ওই সময়টাতে জাপানের জিডিপির হার ছিল ৯ শতাংশ। তখনকার জাপানের অর্থনৈতিক উন্নয়নের বৈশিষ্ট্যগুলোর দিকে তাকালে কী দেখা যায়, জাপান কি শুধু শিল্প দিয়ে জার্মানিকে অতিক্রম করেছিল? না। জাপান কয়লা, লোহা, স্টিল, জ্বালানি উৎপাদনকে মই হিসেবে ব্যবহার করলেও পায়ের নিচে শক্ত মেঝে হিসেবে কাজ করেছিল জাপানের কৃষি। তখনো জাপানের শ্রমশক্তির ৪০ ভাগ ছিল কৃষিতে নিয়োজিত। পরিশ্রমী জাপানিরা বিভিন্ন সেক্টরে ছড়িয়ে পড়েছিল। এই জাপানকে এখন অতিক্রম করতে চলেছে চীন। টোকিওর মাসামিচি আডাচির মতো বিশ্বের অনেক খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ মনে করছেন, চীন এখনো তৃতীয় অবস্থানে থাকলেও এক বছর সময়ের মধ্যেই জাপানকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাবে। এ বছরের প্রথম দিকের হিসাব অনুযায়ী জাপানের জিডিপির পরিমাণ ৫.২৭ ট্রিলিয়ন ডলার। পক্ষান্তরে চীনের জিডিপির পরিমাণ ৪.৯ ট্রিলিয়ন ডলার। চীন দ্রুত জাপানকে পেছনে ফেলে দেবে তার কারণ হলো, চীনের প্রায় ১০ ভাগ প্রবৃদ্ধির বিপরীতে জাপানের বর্তমান প্রবৃদ্ধির হার ৪.৬ ।, চীনের এই অগ্রযাত্রা নিয়ে অনেকে সাধারণভাবে ধারণা করেন, খুব কম দামে ইলেক্ট্রনিক পণ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক বাজার সয়লাব করেই বুঝি চীন অর্থনৈতিকভাবে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে। বিষয়টি মোটেই সে রকম নয়। বহুদিকে ভারসাম্য বজায় রেখে চীনকে এগোতে হচ্ছে। জ্বালানি সংগ্রহ থেকে শুরু করে অস্ত্র বিক্রি কোনোটাতেই চীন পিছিয়ে নেই। চীনের সরকার লক্ষ করেছে জনসাধারণের মধ্যে শহরে চলে আসার প্রবণতা দেখা দিয়েছে। তাই সম্প্রতি সরকার জনসাধারণকে কৃষি কাজে আকর্ষণ করার জন্য বেশ কয়েকটি বড় ধরনের প্রকল্প গ্রহণ করেছে। সঙ্গে একচেটিয়া শহরে প্রবেশের ওপর একটি অলিখিত শর্তারোপ করে দিয়েছে। সঙ্গে বিভিন্ন প্যাকেজের মাধ্যমে স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করে তুলেছে। চীন এসব নিয়ে শুধু ফাইল চালাচালিতে সীমাবদ্ধ থাকেনি; যেই বলা সেই কাজ। উল্লেখ্য, চীনে তিরিশ কোটি মানুষ সরাসরি কৃষি কাজের সঙ্গে জড়িত। কৃষিতে উন্নয়ন এবং নিরাপদ করার জন্য বেইজিং এগ্রিকালচার ইউনিভার্সিটিকে প্রাধান্য দিয়ে সরকার ব্যাপক গবেষণা ও পরিকল্পনার কাজে হাত নিয়েছে।
যে কোনো দেশের অর্থনীতি এখন অনেক ক্ষেত্রে গুরুত্বের সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে। যেমন- অর্থনৈতিক উন্নয়নে এখন দেশে দেশে পর্যটন একটি বড় ভূমিকা রাখছে। যে দেশগুলো এগোচ্ছে সে দেশগুলো শিল্পোন্নয়ন ও কৃষি উন্নয়নের পাশাপাশি সমান গুরুত্ব দিচ্ছে এ খাতকে। পর্যটনের আয় অনেকটা নগদ নারায়ণের মতো। এর মজা যে দেশ পেয়েছে সেই দেশই জানে। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করা যায়, বাংলাদেশ এই পর্যটন আয় থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত। ভারত, নেপাল বা মালদ্বীপের কথা বাদ দিয়ে শ্রীলংকাকেই ধরা যাক। প্রতিবেশী এই যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ শ্রীলংকায় গড়ে মাসে ৪০ হাজার ট্যুরিস্ট প্রবেশ করে থাকে! পক্ষান্তরে বাংলাদেশে বছরে ৪০ হাজার ট্যুরিস্ট প্রবেশ করে কি না তা পর্যটন করপোরেশন ভালো বলতে পারবে। কেন বাংলাদেশে ট্যুরিস্ট আসে না? এখানে কি দেখার মতো, উপভোগ করার মতো কিছুই নেই? অবশ্যই আছে। কিন্তু আসবে কেন? শ্রীলংকা ট্যুরিস্টদের নিরাপত্তা দিতে পারে, সেখানকার ম্যানেজমেন্ট আন্তর্জাতিক মানের। পক্ষান্তরে ট্যুরিস্টদের আকৃষ্ট করার কোনো পদ্ধতিই আমাদের জানা নেই, আমরা তাদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারিনি। পৃথিবীতে ১৫ কোটি বা ততোধিক লোকসংখ্যার কোনো দেশে বাংলাদেশের মতো এত অল্পসংখ্যক ট্যুরিস্ট আসে না।
আবার ধরা যাক শ্রমবাজারের কথা। বাংলাদেশের জন্য এরচেয়ে করুণ কাহিনী আর কিছু নেই। ভারত, পাকিস্তান বা বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় সবচেয়ে কম মূল্যে বাংলাদেশ মধ্যপ্রাচ্যের বিশাল বাজারে শ্রম রপ্তানি করে থাকে। পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রও কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে শ্রম রপ্তানি করে থাকে। কিন্তু সেটা একটু ভিন্ন ফর্মে। যুক্তরাষ্ট্র যে টিচার বা প্রকৌশলী মধ্যপ্রাচ্যে পাঠাচ্ছে তার একজন আয় করছেন বাংলাদেশের পাঠানো ২০০ অদক্ষ শ্রমিকের সমান। এভাবে সংখ্যায় লাখ লাখ শ্রমিক দিনের পর দিন মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ঘণ্টার পর ঘণ্টা শ্রম দিয়ে না পারছেন নিজের ভাগ্য ঘোরাতে, না পারছেন দেশের অর্থনীতির ভাগ্য পরিবর্তন করতে। যে পরিমাণ শ্রম বাংলাদেশের মানুষ বিদেশে দিচ্ছেন তার উপযুক্ত আয় থেকে ব্যক্তি ও রাষ্ট্র মারাত্দকভাবে বঞ্চিত।
বিমানবন্দর বাণিজ্য, সমুদ্রবন্দর বাণিজ্যসহ আরো অনেক অনেক বিষয় উল্লেখ করা দরকার ছিল, পারা গেল না। তবে মধ্য আয়ের দিকে যেতে হলে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। লক্ষ করলে দেখা যাবে, যে দেশগুলো অগ্রসর হচ্ছে তার কোনোটিতেই বাংলাদেশের মতো এমন রাজনৈতিক অস্থিরতা নেই। অসম্ভব প্রাকৃতিক সম্পদ থাকা সত্ত্বেও আফ্রিকার দেশগুলো পিছিয়ে পড়েছে শুধু রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাবে। পাকিস্তান, আফগানিস্তানের বেলায়ও একই কথা বলা যায়। মধ্য আয়ের কোনো দেশে কথায় কথায় রাস্তায় গাড়ি ভাংচুর নেই, কথায় কথায় জাতীয় সম্পদ পুড়িয়ে দেওয়ার রেওয়াজ নেই। এত সংঘর্ষের পরও এ বছর আইএমএফ শ্রীলংকাকে মধ্য আয়ের দেশ বলে ঘোষণা করেছে। কিন্তু সে সহিংসতার একটি চরিত্র আছে। শ্রীলংকায় ছিল জাতিগত সংঘাত, কলম্বোতে অনেক ভয়াবহ বোমা বিস্ফোরণ হয়েছে সেটাও ঠিক। কিন্তু সেখানে কলম্বোর মানুষরা কোনো কিছুর নামকরণের প্রতিবাদে রাস্তার যানবাহন ব্যাপকভাবে ভাংচুর করেনি। আবার কোনো সরকারও ক্ষমতায় এসে অন্য রাজনৈতিক দলের নামকরণকে মুছে ফেলার রাজনীতিতে মনোযোগ দেয়নি।
এসব কারণেই শুধু গার্মেন্ট সেক্টর দিয়ে, প্রবাসী শ্রমিকের ঘামে ভেজা রেমিট্যান্সের জোরে বা কৃষিতে কয়েক হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েই স্বল্প আয় থেকে মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হওয়া কোনোক্রমেই সম্ভব হবে না। এ জন্য প্রয়োজন দক্ষ সরকার, স্বচ্ছ প্রশাসন ও পরিণত রাজনৈতিক বোধ। সেসব কি আপাতত বা নিকট ভবিষ্যতে আমরা নাগাল পাব? তাই আসাফউদ্দৌলার মন্তব্যগুলো এখনো বাতিল করে দেওয়ার কোনো উপায় নেই। তবে তারপরও আমরা আশাহত হবো না। পরিশ্রম ও মেধার সমন্বয় হলে দেরিতে হলেও সাফল্য আমাদের আসবে।লেখক : সাংবাদিক    mohshinhabib@yahoo.com     Source 

No comments:

Post a Comment