‘দুই নেত্রী জাতিকে নিয়ে জুয়া খেলছেন’
‘এতক্ষণে অরিন্দম কহিলা বিষাদে’।. অবশেষে বিএনপি বাজেট অধিবেশনে যোগ দিয়েছে এবং পুরো অধিবেশনেই থাকবে বলে অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে। মন্দের ভালো! কিন্তু এটি নিয়ে উদ্বেলিত, উচ্ছ্বসিত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এ জন্য সাবেক চারদলীয় বা বর্তমানে ১৮-দলীয় জোট কোনো ধন্যবাদ পাওয়ার দাবি রাখে না। যে দেশেই সংসদীয় গণতন্ত্র প্রচলিত আছে সেই দেশে শুধু জোট নয়, প্রত্যেকটি সংসদ সদস্যের নৈতিক দায়িত্ব সংসদে তার উপস্থিতি। নিরবচ্ছিন্নভাবে সংসদ বর্জন অথচ সংসদ সদস্যদের সব সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ কেবল সংসদকেই অকার্যকর করে না, গণতান্ত্রিক চেতনাকে অবলুপ্তির দিকে ঠেলে দেয় না, সংঘাত ও বিপর্যয়ের রাজনীতিকে উৎসাহিত করে না, একই সঙ্গে সমগ্র বিশ্বের কাছে জাতির মাথাও হেঁট করে দেয়। অথচ বেদনাহত চিত্তে গোটা জাতিকে বার বার এই দুঃসহ জ্বালা সহ্য করতে হচ্ছে। এ প্রশ্নে আওয়ামী লীগও ব্যতিক্রম নয়। মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ।
অবস্থাদৃষ্টে এবং রাজনৈতিক পর্যালোচনায় যে কথাটি আজ প্রদীপ্ত সূর্যরশ্মির মতো সত্য তা এই যে, ক্ষমতাসীন আর বিরোধী দল উভয়েই ক্ষমতাকেন্দ্রিক এবং এদের উভয়েরই সংসদ তো বটেই, দলের অভ্যন্তরীণ আঙ্গিকে গণতন্ত্রের অনুশীলন বিলুপ্ত।সংসদের বাইরে থেকে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুটি ছাড়া ‘দেশনেত্রী’র নিজের সন্তান, ক্যান্টনমেন্টে তার অবৈধ অবস্থান রক্ষাকেই রাজনীতির মুখ্য বিষয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার ব্যর্থ চেষ্টা করেছেন। শেয়ার বাজার, হলমার্ক, ডেসটিনি, যুবক ইত্যাদি জাতীয় ইস্যুতে তাদের নির্লিপ্ততা জনগণের হৃদয়ে তাদের স্বচ্ছতা সম্পর্কেও প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে।
সাম্প্রতিককালে হেফাজতে ইসলামের ঘাড়ে বন্দুক রেখে তুড়ি মেরে বাজিমাত করার যে নীল নকশা বেগম খালেদা জিয়া করেছিলেন সেটি ভ-ুল হওয়ায় তিনি অনেকটাই মুষড়ে পড়েছেন বলে মনে হয়। সম্প্রতি তারেক রহমানের দেশে প্রত্যাবর্তন নিয়ে যে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে সেই বিতর্কে না জড়িয়েও বলা যায় যে, অরাজনৈতিক, অমার্জিত, অশালীন মন্তব্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যে পারদর্শিতা ইতোমধ্যে দেখিয়েছেন তার আঙ্গিকে অনেক নন-ইস্যুকে ইস্যুতে পরিণত করার সুযোগ বিএনপি পেয়েছে। সম্প্রতি সংসদের অধিবেশন বয়কটে সেই দৃষ্টান্ত প্রতিস্থাপিত হয়েছে। গণতন্ত্রের সংজ্ঞায় উত্থাপিত যে কোনো অভিযোগের জবাব দেওয়ার অধিকার অভিযুক্তের থাকে। গণতান্ত্রিক চর্চা সংসদীয় দলেও অনুপস্থিত বলেই এরকম একটি উদ্ভট দৃষ্টান্ত জাতিকে দেখতে হলো বাজেটের প্রথম অধিবেশনে।
রাজনীতিতে তারেক রহমানের উপস্থিতি দেশের রাজনৈতিক ধারায় কতটুকু বিবর্তন, উচ্ছ্বাস ও উদ্বেলতা সৃষ্টি করবে তা আমার জানা নেই। ইন্টারপোলের মাধ্যমে তাকে আনা সম্ভব কিনা সে বিতর্কও অবান্তর। বাংলাদেশের মানুষ গণতন্ত্রের জন্য বহুবার অকাতরে বুক নিঃসৃত রক্ত ঝরিয়েছে কিন্তু তাদের স্মৃতিশক্তির দুর্বলতা কখনো কখনো জাতিকে বিপথগামীও করেছেথ এটি সত্য ধরে নিলেও বাংলার মানুষকে আহাম্মক ভাবার কোনো সুযোগ নেই। হাওয়া ভবন, বিকল্প প্রশাসন, দলীয়করণ, একুশে আগস্টের নির্মমতা বাংলাদেশের মানুষ বিস্মৃত হয়েছে বা বেমালুম ভুলে বসে আছে তা ভাবা রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয় বহন করে না। তবুও এ কথা বলতে হয় জাতির পরিত্রাণের জন্য নয়, দলের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থে তারেক রহমান দেশে ফিরে এসে আইনের মোকাবিলা করে তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের মীমাংসা করা। এই ন্যূনতম সাহসটুকু না দেখাতে পারলে রাজনীতি থেকে নির্বাসন নেওয়াটাই তার জন্য হবে সম্মানজনক। এ কথা সত্য, ক্যান্টনমেন্টের গর্ভে, সামরিক ব্যক্তিত্বের ঔরসে বিএনপির জন্ম এবং এ দলটি ক্ষমতাকেন্দ্রিক। কিন্তু নির্যাতন নিগ্রহের মুখে বিড়ালের মতো মেও মেও করলে এক দিন না এক দিন এ সংগঠনের অবকাঠামো ভেঙে পড়বেই। রাজনীতি করব অথচ কারাগারের ফটক মাড়াব না, এটি গ্রহণযোগ্য নয়। খালেদা জিয়া যখন ৪৮ ঘণ্টা সময়সীমা বেঁধে দিলেন এবং তারপর হেফাজতে ইসলামের বিপর্যয়ের পর ল্যাজ গুটিয়ে ঘরে বসে না থেকে স্বেচ্ছা কারাবরণের একটি ডাক যদি তিনি দিতে পারতেন এবং কমপক্ষে জনসংখ্যার এক শতাংশ অর্থাৎ ১৬ লাখ লোককে স্বেচ্ছা কারাবরণের পথে নামাতে পারতেন তাহলে তার ছুড়ে দেওয়া চ্যালেঞ্জেরই শুধু সম্মান রক্ষা হতো না, দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন একটি সুসঙ্গত ধারায় প্রতিহিংসাপরায়ণতার পথ ছেড়ে একটি সুশৃক্সখল গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতার সৃষ্টি করত এবং এতে করে প্রধানমন্ত্রীর এত বেপরোয়া হয়ে ওঠার দ্বার উন্মুক্ত হতো না। হেফাজতে ইসলামের ব্যর্থতা এবং গণজাগরণ মঞ্চের আংশিক অকৃতকার্যতায় প্রধানমন্ত্রীর কতটুকু হাত রয়েছে সে বিচার ইতিহাস করবে। কিন্তু এখন প্রধানমন্ত্রী নিজেকে লৌহমানবী মনে করেন এবং তার অনেক সিদ্ধান্ত তাকে এই ধারণায় বিশ্বাসী করতে অনুপ্রাণিত করেছে। ভ্রান্ত বাম তার চারদিকে যে বাস্তিল দুর্গটি রচনা করে জনগণের কাছ থেকে তাকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করেছে, আওয়ামী লীগকে কমিউনিস্ট লীগে রূপান্তরিত করেছে এবং প্রতিটি মুহূর্তে তার কর্ণকুহরে এই মন্ত্রণা দিচ্ছে যে, শুধু বাংলাদেশেই নয়, পৃথিবীজোড়া তার নেতৃত্ব অপ্রতিরোধ্য। তাই তার জনপ্রিয়তার ব্যারোমিটারের পারদ কোথায় এটিকে পরিলক্ষণ করার শক্তি ক্রমেই তিনি হারিয়ে ফেলছেন। ড. ইউনূসকে নিয়ে বাড়াবাড়ি, বিশ্বব্যাংকের প্রতি অসংযত উক্তি এবং জাতিসংঘের বিরুদ্ধেও তার বিষোদগার ইত্যাদি কারণে বিশ্বরাজনীতির চর্চায় তিনি কোথায় এসে দাঁড়িয়েছেন সেটি পরিমাপ করার সুযোগ বোধহয় এখন আর নেই। দেশের অভ্যন্তরে দুর্নীতি আজ সর্বগ্রাসী। কিছু ব্যতিক্রম বাদে সংসদ সদস্যরা তো বটেই, প্রশাসন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকরা অধিকাংশই, এমনকি আদালত অঙ্গন আজ শুধু দলীয়করণে চৌচির হয়ে যায়নি বরং অবক্ষয়ের অতলান্তে নিক্ষিপ্ত। একই সঙ্গে আমরা যদি পাশ্র্ববর্তী দেশের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাব সেখানে গণতন্ত্র সুসংহত আর এর অন্যতম কারণ গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো সেখানে গণতন্ত্রের চর্চা করে। দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের অনুশীলন রয়েছে এবং জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় দলমত নির্বিশেষে সবারই একটি অভিন্ন মত গড়ে তোলার বহু দৃষ্টান্তও রয়েছে সেখানে। এমনকি পাকিস্তানে, যেখানে কোনোদিনই গণতন্ত্র তার আপন মহিমায় বিকশিত হতে পারেনি সেখানেও বিচারব্যবস্থা পর্বতশৃঙ্গের মতো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সেখানেও জাস্টিস কায়ানি, জাস্টিস ইব্রাহিম, জাস্টিস মুর্শেদ এবং বিচারপতি বি. এ. সিদ্দিকীর ন্যায় গর্ব করার মতো ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব ঘটে। কিন্তু আমাদের দেশের আইনজ্ঞরা আদালত প্রাঙ্গণকে দলবাজির অভয়ারণ্যে পরিণত করেছে এবং আইনজ্ঞদের দলবাজির উত্তাপ বিচারকদেরও অনেকাংশে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। প্রশাসনের দলীয়করণের নির্লজ্জ প্রকাশ হাওয়া ভবন থেকে শুরু, যা ক্রমশই প্রকট থেকে প্রকটতর হয়ে আজ একটি বিভীষিকায় পরিণত হয়েছে। পদায়ন, পদোন্নতি দলীয় আনুগত্যের বাইরে প্রত্যাশা করাও অপরাধ।
দৈনন্দিন জীবনে মানুষের দুর্গতি এমনই বিপর্যয়মুখী যে, শুধু দ্রব্যমূল্যের কারণেই নয়, ফরমালিনের ভয়েও মানুষ আজ বিপন্ন বোধ করছে। তাছাড়া রাজনীতিতেও যে ফরমালিন সংযুক্ত হয়েছে তার দায়ভার শীর্ষ নেতৃত্বকেই নিতে হবে। এই নিবন্ধটির সারাটি আঙ্গিকেই নেতিবাচক উক্তি রয়েছে। বেদনাদায়ক হলেও এটিই দেশের বাস্তব চিত্র। তবুও প্রশ্ন ওঠা উচিত যে, এর থেকে নিষ্কৃতির উপায় কী? আমাদের অতীত ইতিহাস স্বগৌরবে স্মরণ করিয়ে দেয় আমাদের জাতীয় চেতনার উন্মেষ থেকে শুরু করে স্বাধীনতা পর্যন্ত সব পর্বেই গণমানুষ ভিসুভিয়াসের মতো জ্বলে উঠেছে। কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন আদর্শ, সাহস এবং ভয়-ভীতি-প্রলোভন বিমুক্ত একটি নেতৃত্ব। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা, মওলানা ভাসানী এবং ষাট দশক থেকে বঙ্গবন্ধুর অকুতোভয় চেতনা জাতিকে আলোকিত করেছিল, উদ্বেলিত করেছিল, উচ্ছ্বসিত করেছিল এবং ছাত্রলীগের প্রত্যয়দৃঢ় ভূমিকা একে শেষ পর্যন্ত সাফল্যের সৈকতে পৌঁছে দিয়েছিল। আমি সেই সুদীর্ঘ আন্দোলনের পথপরিক্রমার একজন সহযাত্রী থাকার অধিকারে নির্দ্বিধায় বলতে চাই যে, এই ঘোর অমানিশার রাতেও চরম নিরাশার শিকার হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
তবে একটি বিষয় এখন অতি স্পষ্ট আর তা হলো দুই নেত্রীই জাতিকে নিয়ে জুয়া খেলছেন। এ অবস্থায় সমাজের বিভিন্ন স্তর যেমন : ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজ, সাংবাদিক এদের মধ্য থেকে একটি অংশকে অকুতোভয়ে মাথা উঁচু করে মেরুদ- খাড়া করে এগিয়ে আসতে হবে। এ পথ নিষ্কণ্টক নয়। এ পথে বাধা বিস্তর। প্রাপ্তি-প্রত্যাশার চেতনাকে সম্পূর্ণ বিসর্জন দিতে হবে। দুই জোটের বাইরে যারা আছেন তাদের শুধু মোর্চা গঠনই নয়, তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচির মধ্যে এই সত্যটিকে প্রতিভাত করতে হবে প্রাপ্তি বা প্রত্যাশার আঙ্গিকে নয়, জেল-জুলুম-খুন-গুমকে তারা পরোয়া করেন না বরং জাতির চরম দুর্দিনে তারা নির্ভীক চিত্তে এগিয়ে এসেছেন এবং তারা অবশ্যই পারবেন জাতির মনে এই প্রতীতি জন্মাতে যে, আমাদের অবদমিত রাখার অপশক্তিকে রোখা কঠিন কিন্তু অসাধ্য নয়। তখনই জাতি সমস্বরে জেগে উঠে বলবে- ‘সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালোবাসিলাম, সে কখনো করে না বঞ্চিত।’
লেখক :নূরে আলম সিদ্দিকী ( রাজনীতিক ) Source
সাম্প্রতিককালে হেফাজতে ইসলামের ঘাড়ে বন্দুক রেখে তুড়ি মেরে বাজিমাত করার যে নীল নকশা বেগম খালেদা জিয়া করেছিলেন সেটি ভ-ুল হওয়ায় তিনি অনেকটাই মুষড়ে পড়েছেন বলে মনে হয়। সম্প্রতি তারেক রহমানের দেশে প্রত্যাবর্তন নিয়ে যে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে সেই বিতর্কে না জড়িয়েও বলা যায় যে, অরাজনৈতিক, অমার্জিত, অশালীন মন্তব্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যে পারদর্শিতা ইতোমধ্যে দেখিয়েছেন তার আঙ্গিকে অনেক নন-ইস্যুকে ইস্যুতে পরিণত করার সুযোগ বিএনপি পেয়েছে। সম্প্রতি সংসদের অধিবেশন বয়কটে সেই দৃষ্টান্ত প্রতিস্থাপিত হয়েছে। গণতন্ত্রের সংজ্ঞায় উত্থাপিত যে কোনো অভিযোগের জবাব দেওয়ার অধিকার অভিযুক্তের থাকে। গণতান্ত্রিক চর্চা সংসদীয় দলেও অনুপস্থিত বলেই এরকম একটি উদ্ভট দৃষ্টান্ত জাতিকে দেখতে হলো বাজেটের প্রথম অধিবেশনে।
No comments:
Post a Comment