Friday, July 26, 2013

Hamid Mir : On Egypt

মুহাম্মদ মুরসি, আয়মান আল জাওয়াহেরি এবং ওবামা

লেখকঃ হামিদ মীর , পাকিস্তানের জিও টিভির নির্বাহী সম্পাদক



আল কায়েদা নেতা ডা. আয়মান আল জাওয়াহেরি চৌদ্দ বছর বয়সে ইখওয়ানুল মুসলিমিনে (মুসলিম ব্রাদারহুড) যোগ দেন। তবে যৌবনের বারান্দায় পা রাখার পর তিনি ইখওয়ান ত্যাগ করেন। ইখওয়ান রাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমে ইসলামি শাসনব্যবস্থা কায়েমের চেষ্টা করে যাচ্ছিল। কিন্তু জামাল আবদুন নাসেরের শাসনামলে ইখওয়ান নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়। এই নিষেধাজ্ঞার ফলে ইখওয়ানের সমর্থক অনেক যুবক প্রতিবাদ- বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। সরকার প্রতিবাদরত কিছু যুবককে রাষ্ট্রদ্রোহী আখ্যায়িত করে কারাগারে পাঠায় এবং তাদের ওপর নির্মমভাবে অত্যাচার করে। কারাগারে নির্মমভাবে নির্যাতিতদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ডা. আয়মান আল জাওয়াহেরি। তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর মিসরের শাসনব্যবস্থা পরিবর্তনের জন্য রাজনৈতিক আন্দোলনের পরিবর্তে সশস্ত্র আন্দোলনের পথ গ্রহণ করেন। তিনি তার পুরাতন ইখওয়ানি সাথীদের বলেন, তারা রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক পন্থায় মিসরে ইসলামী শাসনব্যবস্থা চালু করতে পারবে না। কেননা রাষ্ট্রযন্ত্রে সেকুলারপন্থীরা আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছে। আর এই সেকুলারপন্থীরা নিজেদের মতা টিকিয়ে রাখার জন্য জগতের সব ধরনের জুলুমকে বৈধ মনে করে। সুতরাং ভোট দ্বারা নয়, এই জালেমদের মোকাবেলা করতে হবে অস্ত্র দিয়ে।

ইখওয়ানের বেশ কিছু যুবক ডা. আয়মান আল জাওয়াহেরির সাথে এসে যোগ দেয়। তবে বেশির ভাগ ইখওয়ানকর্মীই তাদের রাজনৈতিক আন্দোলন অব্যাহত রাখে। ২০১২ সালে ইখওয়ান ‘ফ্রিডম এন্ড জাস্টিস পার্টি’ নামে মিসরের নির্বাচনে অংশ নিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে এবং মুহাম্মদ মুরসি মিসরের প্রেসিডেন্ট হন। মুহাম্মদ মুরসি প্রেসিডেন্ট হওয়ার কিছু দিন পর ডা. আয়মান আল জাওয়াহেরি এক দীর্ঘ অডিও বার্তা প্রকাশ করেন, যাতে তিনি মুরসির সমালোচনা করে বলেন, মুরসি ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার জন্য কোনো কার্যকর পদপে নেননি। মুরসি নন, বরং আল জাওয়াহেরির সমালোচনার মূল টার্গেট ছিল তার পুরাতন দল ইখওয়ানুল মুসলিমিন। আল জাওয়াহেরি তার ৫৮ মিনিট দীর্ঘ অডিও বার্তায় এটা প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে, গণতন্ত্র হচ্ছে প্রতারণা। আর ইখওয়ানুল মুসলিমিনের নেতৃত্ব গণতন্ত্রের মাধ্যমে মিসরে কোন পরিবর্তন আনতে পারবে না। এক দিকে ডা. আয়মান আল জাওয়াহেরির সমালোচনা, অপর দিকে মুরসিকে সেনাবাহিনী ও আদালতের অসহযোগিতার মুখোমুখি হতে হয়।

জনগণের সমস্যার সমাধান না হতেই এক বছরের মাথায় সেনাবাহিনী, আদালত এবং মুহাম্মদ এল বারাদি আননুর পার্টিকে সাথে নিয়ে মুহাম্মদ মুরসির নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে। মুহাম্মদ মুরসির নির্বাচিত সরকার উৎখাতে আমেরিকা ও জাতিসঙ্ঘের নীরবতায় এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, মিসরের সেনাবাহিনীর জেনারেলরা বিশ্বশক্তির আশীর্বাদ নিয়েই মুহাম্মদ মুরসির নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে। মুহাম্মদ মুরসির মধ্যে অনেক অনভিজ্ঞতাপ্রসূত ভুল ছিল, কিন্তু যেভাবে ক্ষমতা থেকে তাকে অপসারণ করা হলো সে পদ্ধতি তাকে মিসরের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের দৃষ্টিতে মজলুম হিসেবে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।

এখন এ প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ নয় যে, মুহাম্মদ মুরসি প্রেসিডেন্ট পদে এখনো বহাল আছেন, না নেই। বরং এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে ৩ জুলাই, ২০১৩ মিসরে সেনাবিদ্রোহের পর যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে তার ফলাফল কী হবে? আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে বলে, মিসরের গৃহযুদ্ধ থেকে সবচেয়ে বেশি ফায়দা নেবে ডা. আয়মান আল জাওয়াহেরি। পাকিস্তান-আফগানিস্তানসহ বেশ কিছু মুসলিম দেশে এই গৃহযুদ্ধের প্রভাব পড়বে। মিসরে ইসলামপন্থীদের নির্বাচিত সরকারকে ট্যাংক ও অস্ত্রের শক্তি দ্বারা উৎখাতকারীরা ডা. আয়মান আল জাওয়াহেরির চিন্তাভাবনাকে প্রমাণ করে দিলো, গণতন্ত্রের মাধ্যমে দিনবদল করা যায় না।

আমরা এই বাস্তবতাকে উপেক্ষা করতে পারব না যে, ডা. আয়মান আল জাওয়াহেরির সম্পর্ক মিসরের এমন এক খান্দানের সাথে যাদের প্রচুর খ্যাতি ও সুনাম রয়েছে। তার পিতা ডা. রবী আল জাওয়াহেরি কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যালের প্রফেসর ছিলেন। এই পরিবারের সন্তান ডা. আয়মান আল জাওয়াহেরি নিজেও একজন সার্জন। তার সম্পর্ক ছিল মিসরের উচ্চ শিক্ষিত মহলের সাথে। কিন্তু রাষ্ট্রের সীমাহীন নিপীড়ন নির্যাতনের প্রতিবাদ করতে গিয়ে আল কায়েদায় যোগ দেন। ১৯৯৬-এর এপ্রিলে ডা. আয়মান আল জাওয়াহেরি ও ওসামা বিন লাদেন সুদানে অবস্থান করছিলেন। এটা সেই সময়ের কথা, যখন ওসামা বিন লাদেন ও তার সহকর্মীরা সুদানে বসে সারা বিশ্বের ইসলামি আন্দোলনকে জিহাদে রূপ দেওয়ার কার্যক্রম পরিচালনা করছিলেন, সে সময় সুদানের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে ওসামা বিন লাদেন হাসান আত তুরাবিকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন। তুরাবি নির্বাচনে জয় লাভ করেন এবং সুদানের পার্লামেন্টের স্পিকার নির্বাচিত হন। কিন্তু তৎকালীন সুদানি প্রেসিডেন্ট উমর আল বাশার আমেরিকার চাপে ওসামা বিন লাদেনকে সুদান ত্যাগের নির্দেশ দেন। হাসান আত তুরাবি পার্লামেন্টের স্পিকার হওয়া সত্ত্বেও ওসামা বিন লাদেনকে সাহায্য করতে পারেননি। ওসামা বিন লাদেন ১৯৯৬ সালের মে মাসে সুদান থেকে আফগানিস্তান আসেন।

আমার স্মরণ আছে, ১৯৯৭-এর মার্চে ওসামা বিন লাদেনের সাথে আমার মোলাকাত হয়েছিল। তার সাথে মিসরের অন্ধ আলেম উমর আবদুর রহমানের এক ছেলেও ছিলেন। উমর আবদুর রহমান আমেরিকাতে বন্দী আছেন। তিনিও ইখওয়ানুল মুসলিমিনের মাধ্যমে রাজনৈতিক আন্দোলন শুরু করেছিলেন। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা জারির পর তিনি মিসর সরকারের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেন। ১৯৯৮-এর মে মাসে কান্দাহারে ওসামা বিন লাদেনের সাথে সাক্ষাতের সময় ডা. আয়মান আল জাওয়াহেরিও ছিলেন। আল জাওয়াহেরি আমাকে আলজেরিয়ার দৃষ্টান্ত দিয়ে বললেন, ইসলামিক স্যালভেশন ফ্রন্ট নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করতে পারেনি। আলজেরিয়ার সেনাবাহিনী ইসলামপন্থীদের উৎখাত করতে সর্বাত্মক অভিযানে নামে। ইসলামিক স্যালভেশন ফ্রন্টের পরিণাম সারাবিশ্বের ইসলামী আন্দোলনের জন্য একটি চরম শিা।

১১ সেপ্টেম্বর, ২০০১ সালে নিউ ইয়র্ক ও ওয়াশিংটনে আল কায়েদার হামলার দুই মাস পর আফগানিস্তানে ওসামা বিন লাদেন ও ডা. আয়মান আল জাওয়াহেরির সাথে আরো একটি দীর্ঘ সাক্ষাতের সুযোগ হয়। আল জাওয়াহেরি বলেন, পাকিস্তানের সংবিধানে সেনাবিদ্রোহকে গাদ্দারি বলা হয়। কিন্তু পাকিস্তানে সেনাবিদ্রোহীদের পাক-আদালত ‘বিদ্রোহী’ আখ্যায়িত করেন না। বরং তাদের বিদ্রোহকে আবশ্যক ছিল বলে বৈধ ঘোষণা করা হয়। সুতরাং পাক-সংবিধান একটি মশকারা সংবিধান। এ ধরনের মশকারা না বাঁচাতে পারবে গণতন্ত্র, না বাঁচাতে পারবে পাকিস্তানকে। জিহাদই শুধু পাকিস্তানকে বাঁচাতে পারে। আমি আল জাওয়াহেরির সাথে বিতর্ক করিনি।

কিছু দিন আগে ডা. আয়মান আল জাওয়াহেরির একটি গ্রন্থ আস সুবহ ওয়াল কিনদীল নামে প্রকাশিত হয়। যার উর্দু তরজমা সাপিদা সাহার আওর টিমটিমাতা চেরাগ (শুভ্রসকাল ও নিভুনিভু প্রদীপ) নামে আমার হাতে আসে। এই গ্রন্থে তিনি পাকিস্তানের সংবিধানকে কুফরি আখ্যায়িত করেছেন। কেননা এ সংবিধানের ৩৮ নং ধারায় সুদ বন্ধের ওয়াদা করা হয়েছে। অথচ এ ওয়াদা পূরণ করা হয়নি। এ ছাড়া পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে মাফ করার এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে। ডা. আয়মান আল জাওয়াহেরির সাথে আমি একমত নই। কেননা পাক-পার্লামেন্ট চাইলে সুদ বন্ধ করতে পারে। সংবিধানে এই এখতিয়ার দেয়া আছে। পার্লামেন্ট চাইলে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে মা করার এখতিয়ার প্রেসিডেন্ট থেকে প্রত্যাহার করে নিতে পারে। সংবিধানে আরো উপায় রয়েছে। অপরাধ সংবিধানের নয়। অপরাধ আমাদের নির্বাচিত পার্লামেন্ট সদস্যদের।

তবে আমাকে এই বিষয়টা বেশি পীড়া দিচ্ছে যে, সেনাবাহিনীর অফিসারদের যোগসাজশে কিংবা রাজনীতিকদের অযোগ্যতা ও স্বার্থপরতা- যেভাবেই গণতন্ত্রকে নস্যাৎ করা হোক না কেন- ফায়দা তারাই লুটবে যারা অস্ত্র ও বোমার দ্বারা দিনবদল করতে চায়। এ কথা ভুলে যাবেন না, ইখওয়ানুল মুসলিমিন শুধু মিসরে নয়, বরং সুদান, লিবিয়া, সোমালিয়া, তিউনিসিয়া, আলজেরিয়া, ইয়েমেন, কুয়েত, ইরাক, জর্ডান, সিরিয়া, বাহরাইন, মৌরিতানিয়া ও ইন্দোনেশিয়াতে বিভিন্ন নামে নির্বাচনের রাজনীতিতে অংশ নিচ্ছে। ফিলিস্তিনের হামাসকেও ইখওয়ানের সহযোগী ও সমর্থক মনে করা হয়। পাকিস্তানের জামায়াতে ইসলামীকেও ইখওয়ানের সম-আদর্শের ভাবা হয়। মুহাম্মদ মুরসির সরকার উৎখাত এসব দেশের বিক্ষুব্ধ যুব সম্প্রদায়কে লড়াইয়ের প্রতি ধাবিত করবে। যারা আফগান তালেবান ও পাক তালেবানকে অস্ত্র পরিহার করে আইনের আওতায় থেকে আলোচনার কথ বলছেন, তারা মুহাম্মদ মুরসির পরিণামে বেশ চিন্তিত। ধরে নেন, আফগান তালেবান অস্ত্র ত্যাগ করে আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণের ঘোষণা দিলো এবং নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতাও অর্জন করল, কিন্তু এর কী নিশ্চয়তা আছে যে, বিশ্বশক্তি তাদের সাথে সেই ব্যবহার করবে না, যা তারা আলজেরিয়া ও মিসরে ইসলামপন্থীদের সাথে করেছে? নির্বাচিত সরকার নির্বাচনের মাধ্যমে আসে এবং নির্বাচনের মাধ্যমে যায়। আমেরিকা ও জাতিসঙ্ঘ মুহাম্মদ মুরসির নির্বাচিত সরকার উৎখাতে নীরবতা অবলম্বন করে বিশ্বব্যাপী ইসলামপন্থীদের ভাবতে বাধ্য করেছে, তারা গণতন্ত্রের পথে চলবে, না তা পরিহার করবে। কেউ মানুক আর না মানুক, মুহাম্মদ মুরসির সরকার মতাচ্যুত হওয়ার কাতারে আফগান তালেবানদের প্রতিনিধি ও আমেরিকা সরকারের মধ্যে আলোচনা অগ্রসর হওয়া বেশ মুশকিল হয়ে পড়ল। মার্কিন সরকারের পলিসি ডা. আয়মান আল জাওয়াহেরির চিন্তাকে সত্য প্রমাণিত করে দিলো। আফগান তালেবান কার ওপর ভরসা করবে? আল জাওয়াহেরির ওপর, নাকি ওবামার ওপর? সবচেয়ে ভালো হয়, ওবামার উচিত মিসরে মুহাম্মদ মুরসির সরকার উৎখাতের প্রকাশ্যে নিন্দা জ্ঞাপন করা।

পাকিস্তানের জাতীয় পত্রিকা দৈনিক জং ০৮ জুলাই ২০১৩ হতে উর্দু থেকে ভাষান্তর ইমতিয়াজ বিন মাহতাব ahmadimtiajdr@gmail.com
 (লেখাটি দৈনিক নয়া দিগন্ত পত্রিকা থেকে নেয়া হয়েছে)।

No comments:

Post a Comment